কুসুমহার ( পরবর্তী পর্ব )
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
(৫)
ওর মা শচীদেবী এবারে শীঘ্রই ওর জন্য একজন বিবাহযোগ্যা সুপাত্রীর সন্ধানী হয়েছেন। ওঁর আশা বল্লভদাস আচার্যের কন্যারত্নটি রমণীমোহনের আবেশ দিয়ে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটিকে ভবিষ্যতের একজন সুযোগ্য সংসারী করে তুলবে। শ্রুত্যানন্দের কথায় ভরসা জেগেছে মনে মনে। এই বল্লভদাস তাঁরও পরিচিতজন। এমনকি তিনি একদা শচী'র স্বামী জগন্নাথ মিশ্রকে উপার্জন বৃদ্ধির সুবিধার জন্য শ্রীহট্ট থেকে এদেশে এসে গুছিয়ে বসতে অনেক বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন। বিশ্বরূপ তখন নেহাতই বালক। আর গৌরাঙ্গ তখন সবে মাতৃগর্ভে আনীত হয়েছে।সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে মনটা ভারী হয়ে ওঠে।
..................
আড়াল থেকে সবটা চুপিচুপি শুনছিল লক্ষ্মীপ্রিয়া। ভাবতেও পারেনি যে এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটবে। বল্লভাচার্য স্বয়ং শ্রুত্যানন্দের মুখের কথাটা যেন কেড়ে নিয়ে বললেন,
" গৌর আমার জামাতা হতে চলেছে এতো বড় সৌভাগ্যের কথা হে! সারা দেশে এমন ছেলে আর ক'টাই বা আছে! আহা ওর আয়ত চোখদুটির দিকে আবেশ ভরে নিষ্পলকে কেই বা তাকিয়ে থাকতে পারে? আমার কন্যার সৌভাগ্য যে সে শচীদেবী তাঁকে যাচনা করেছেন এই আন্তরিক সম্বন্ধে! আমি তো আজ থেকে ওঁদের চিনিনা সেই তো কতদিন আগে থেকেই...."!
এইসব বলতে বলতে নিজে বোধহয় একটু আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তারপর খানিক পরে নিজেই কাঁধে করে একখানি সুবৃহৎ ও পাতাসহ পনস্ ফল এনে শ্রুত্যানন্দের সামনে রাখলেন। তার সঙ্গে কাঁসার ঘটিতে ধবলী গাই এর সদ্য সংগৃহীত গো'দুগ্ধ। এবার গঙ্গোদকে আচমনাদি শেষ করে তাকে এগুলি দিয়ে বললেন,
" আমি এই বিবাহে মঞ্জুর ও দায়বদ্ধ বটে। আপাতত দুই কাহন ধান্য, পনস্ ফলটি ও গোদুগ্ধ বরপণের স্বীকৃতি স্বরূপ তুমি নিয়ে গিয়ে শচীদেব্যাকে দেবে। দিনক্ষণ ঠিক হলে স্বর্ণাঙ্গুরীয় দিয়ে গৌরকে আশীর্ব্বচন করে আসতে অদ্বৈত প্রভু আর শ্রীবাসকে নিয়ে আমি নিজে ওদের গৃহে যাব। আর বৎস, এই নাও গে তোমার মুখরুচির জন্য এই সামান্য দরিদ্র এ গৃহের গৃহিণীর নির্মিত খানকয়েক কদলীর পিষ্টক ও ডাবের অতিমধুর স্বাদের এই সুশীতল পানীয়টি ! "
ততোক্ষণে পিছনের দরজা দিয়ে মানগরবিনীর কুটিরের উদ্দেশ্যে চকিতে লজ্জ্বারুণ লক্ষ্মীপ্রিয়া একছুটে পলায়ন করল।
.........
আজ অবশেষে এল বিবাহের পরমক্ষণটি। গৌর নিজেও লক্ষ্মীর প্রতি অনুরাগকাতর। সে জানে এই বন্ধনটি আদতে তাদের জন্মান্তরের বন্ধন। তাই যেন আয়ত ও সুকুমার মুখমন্ডলে নেমে এসেছে সেই বসন্তসখের কূজন বার্তাটি।
বরবেশে সে যেন আজ গন্ধর্বলোকের অধিবাসী! তার সঙ্গে যে সকল অনুরাগীগণ আজ বল্লভাচার্যের আঙিনায় উপস্থিত তারাও যেন আজ সেই মনসিজের অভিন্ন অন্তরঙ্গআত্মাস্বরূপ।
এদিকে দেবীরূপিণী লক্ষ্মীপ্রিয়া প্রিয়সমাবেশে আকূলা। আর কিছুক্ষণ পরেই সে যে আজ সীমন্তিনী হতে চলেছে। নবদ্বীপ-চন্দ্র গৌরাঙ্গ আজ থেকে তার একান্ত পরম আপনার জনের সেই কাঙ্খিত সেই পদটিতে অবশেষে উন্নীত হবে।
এই আসঙ্গকামনা,এতো আর শুধু আজ থেকে নয়! সেই পরমক্ষণটি যেন যুগে যুগে একসময় অক্ষরিত হয়েছে বলেই আজ সে এজন্মে একান্তে পেয়েছে পরম প্রজ্ঞা আর প্রেমবিহ্বলতার সংমিশ্রণে নবানুরাগের ধারাটিকে।
মধ্যরাতে মিলনের ক্ষণটি যখন আসবে বহুযুগের ওপার থেকে, তখন সেই শালপ্রাংশুমহাভূজ পুরুষোত্তমের আবেশভরা বাহু বন্ধনে ধরা দেবে হ্লাদিনীস্বরূপা সে নিজেই।
...........
(৬)
মাঙ্গলিক সব উপাচার গত দুইটি দিবস আগেই শেষ হয়ে আজ অতি স্বল্প আয়োজনপূর্বক নিয়মকার্যবিধির পরে এসেছে নববিবাহিতযুগলের সেই পুষ্পশয্যার রাত্রিটি।
শচীদেবী তাঁর আর্থিক অবস্হার কথাটি ভেবেই আকূল হচ্ছেন আর ভাবছেন যদিও আজ তিনি যেন অলীক স্বর্গের পরম ঐশ্বর্যটিকেই এতদিনে নিজের হাতে পেয়েছেন তাঁর সেই কনিষ্ঠ পুত্রটির মধ্য দিয়ে।
আজ নিশ্চয় পিতৃলোক থেকে তাঁর স্বর্গীয় স্বামী এই মনোহর যুগলটিকে তাদের যোগ্য ঐশী আশীর্বচনে আরো মধুক্ষরা করে দিচ্ছেন !
আহা! এ যেন এক সত্যিই স্বপ্নময় মহারাত্রি!
.............
গৌরের শয়নকক্ষেও আজ সেই অতিলৌকিক মায়াবন্ধনটি আজ যেন হঠাৎ করে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে ঈষৎ ঘর্মাক্ত লক্ষ্মী বরং আজ মিতবাক। সে তার নিজের পার্থিব দুই চোখ দিয়ে কেবল এক অপার্থিব লাবণ্যময় পুরুষটিকেই দেখছে আর মনে মনে ভাবছে আচ্ছা! এই পলটি আজ সত্যি তো!
গৌরাঙ্গ এতক্ষণে তার মুখে ঈষৎ দুষ্টুমিটির হাসি হেসে তাকে একবার হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলো। আর সে তখন ওই ডাকে আর থাকতে না পেরে একছুটে তার সামনে এসে দাঁড়াতেই গৌরের দেহ থেকে বিচ্ছূরিত সেই সহস্র সূর্যের সাধনার আলো এসে তাকে ভাবাবেশে যেন পাগলপারা করে দিল।
তার ফলে চোখ বুজে এল তীব্র এক প্রেমাবেশে। স্তব্ধবাক সে খালি কানে শুনতে পেল যে গৌর শান্তস্বরে মধু মাখিয়ে তাকে যেন বলছে ,
" তাহলে প্রিয়া! এবারে আর গঙ্গায় স্নানের সময় আড়াল থেকে শুধু আর দেখতে হবে না তো! নবদ্বীপের প্রবীণ স্মার্তরা সবাই বলেন বিপদসংকুল জীবনের ভবতরঙ্গে সন্তরণের সময় প্রকৃত শক্তিস্বরূপা ভার্যা বিনা সব যে বিফল! তাই..."
( ক্রমশ...)
Comments