top of page
Search
agantukpotrika

মহাষ্টমী ।। বিশেষ সংখ্যা ।। ভৌতিক গল্প - বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়


আদিদা ও ভূতিয়া ভালু



বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় 







আদিদার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ক'জন জানে? সে কোন ধরণের অ্যাডভেঞ্চারে মাঝেমাঝেই জড়িয়ে পড়ে? এসব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আদিদার বন্ধুরাও কোনও নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারবে না। কিন্তু আমি পারব। কারণ আমি হলাম গিয়ে আদিদার খাস অ্যাসিস্টেন্ট। আদিদার সাথে প্রায় সমস্ত অ্যাডভেঞ্চারেই আমি গিয়ে থাকি। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন আবিদার প্রথমদিকের অ্যাডভেঞ্চারগুলোতে আমি তার সাথে ছিলাম না।



একদিন আদিদার সাথে তার বাড়িতে কথা হচ্ছিল। আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, "আদিদা, তোমার কোনও অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বলো না যাতে আমি ছিলাম না? তুমি বেশ একাই গিয়েছিলে এবং রহস্যের সমাধান করেছিলে?"



আদিদা হাসল। বলল, "এমন অ্যাডভেঞ্চার খুব বেশি নেই যাতে তুই ছিলিস না৷ তবে একটা ঘটনার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।  তোকে গল্পটা বলি শোন। ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে ছ'-সাত বছর আগে।




ব্যানার্জী জেঠুর কথা তো তুই শুনেছিস। আমার বাবার পিসতুতো দাদা। ব্যানার্জী জেঠু পুলিশে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। বিচিত্র ও ভয় ধরানো সব অভিজ্ঞতা তাঁর। একদিন কথাপ্রসঙ্গে আমায় ফোনে বললেন যে তাঁর পোস্টিং এখন রংপুরে। জায়গাটা পাহাড় ও সবুজ বনে ঘেরা। বেশ স্বাস্থ্যকর। চাইলে আমি দিন কয়েকের জন্য ওঁর কাছে এসে ঘুরে যেতে পারি। এমন বেড়ানোর সুযোগ সবসময় জোটে না। তাই ভাবলাম গিয়ে ঘুরেই আসি। বাবা-মায়ের কাছে অনুমতি পেতে বেশি দেরি হল না। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রংপুরের উদ্দেশ্যে। স্টেশন থেকে নেমে রংপুর প্লাটফর্মে দেখলাম ব্যানার্জী জেঠু দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সাথে এক পুলিশ কনস্টেবল।  পুলিশের জিপ স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছে। সময়টা ছিল বিকেল। 


জেঠু বললেন, 'চলো, তাড়াতাড়ি জিপে উঠে পড়ো। দিনের আলো ফুরোবার আগে আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়তে হবে। নইলে সমস্যা হতে পারে। এখানকার বন জঙ্গল রাতের বেলায় ঠিক নিরাপদ নয়।'


আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন, বিশেষ কোনও কারণ? কোনও শ্বাপদের উৎপাত?'


জেঠু বললেন, 'ঠিক শ্বাপদ নয়, অন্য কিছু। সেটা পথে যেতে যেতে বলব। এখন বাইরের প্রকৃতির শোভা দেখো। মন ভালো হয়ে যাবে।' 



গাড়ি চলতে শুরু করল। রাস্তার চারপাশে উঁচু-নিচু পাইন গাছের জঙ্গল। নরম সূর্যের আলো গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে। আবার কখনও পাহাড়ি বাঁকের মাঝে সূর্যের আলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মায়াময় এক ছায়াঘেরা অন্ধকার এসে ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু। এমন কালচে আলোমাখা সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।


এবড়োখেবড়ো রাস্তার মাঝখান দিয়ে আমাদের জিপগাড়িটা চলছে। আমি জেঠুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'রাতের জঙ্গলে কিসের সমস্যা হয়েছে বলছিলেন?'


ব্যানার্জী জেঠু একটু ইতস্তত করে বলতে লাগলেন, 'এই জঙ্গলের মধ্যে একটা কেল্লা আছে। কেল্লা না বলে তার ভগ্নাবশেষ বলাই ভালো। সেই জায়গার কাছাকাছি বেশ কিছু এমন ঘটনা ঘটছে যে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। রাতের বেলায় এই পথ দিয়ে গেলে বেশ কিছু ভয়ানক প্রাণীর দেখা পাওয়া যাচ্ছে যারা চলন্ত লরি, ট্রাক, বাইক বা জিপগাড়ির চালককে আচমকা আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। কয়েকজন রাতের বেলায় নিখোঁজও হয়েছে। এমনকী দিনের বেলাতেও বেশ কিছু কাঠুরে বনে কাঠ কাটতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। আমাদের কাছে আক্রমণকারীদের কোনও ছবি নেই যা থেকে তাদের চেহারা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।'


আমি বললাম, 'নিখোঁজ কারুর মৃতদেহ বা দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি?'


জেঠু মাথা নেড়ে বললেন, 'না।'


'আপনি ওখানে অনুসন্ধানে গেছিলেন?'


'গেছিলাম তো। দিনের বেলায়। কেল্লার আশেপাশেও ঘুরেছিলাম। কিছু পাইনি।'


'কেল্লার ভিতরে ঢুকেছিলেন?'


'না। সাথের পুলিশ কনস্টেবল ও বনরক্ষীরা অজানা কোনও কুসংস্কারের ভয়ে কেল্লার ভেতরে যেতে চাইছিল না। আমি সামান্যই এগিয়েছিলাম। এক বিশাল বড় বাদুরের ঝাঁক আমাকে লক্ষ্য করে হঠাৎ ধেয়ে আসে। ব্যাপারটা এতই আকস্মিক যে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর একরকম ছুটে কেল্লার বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই সময় দিনের আলোও বেশ কমে এসেছিল। অন্ধকারে সাপখোপ বা অন্য হিংস্র জন্তু থাকতে পারে ভেবে আর ভেতরে যাওয়া হয়নি। এর পরেও কেল্লা অভিযান করতে চেয়েছি। কিন্তু সঙ্গী-সাথীদের দোনামনা ভাব দেখে আর যাওয়া হয়নি।'



জেঠু কথাগুলো বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেছিলেন। আমিও আর কথা বাড়াইনি। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করেছিলাম। এখানকার তাপমাত্রা কেমন, আশেপাশে কোনও ঝর্ণা আছে কিনা, স্থানীয় লোকজন কেমন, এইসব দিকে আলোচনাটা চলে গেছিল।




সেদিন বাংলোয় গিয়ে বিশ্রাম করেই কাটিয়ে দিলাম। পরের দিনটা ছিল শুক্রবার। জেঠু জেঠুর মতো থানায় চলে গেলেন। বাংলায় রয়ে গেলাম আমি এবং জেঠিমা। জেঠুর দুই চাকরও বাড়িতে ছিল না। তারা রান্নাবান্নার জন্য কাছের কোনও বাজারে গেছিল। আমি জেঠিমাকে বলে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখবার জন্য বেরিয়েছিলাম। বন-জঙ্গলে একা একা অ্যাডভেঞ্চার আমার বরাবরই বেশ প্রিয়। লোকালয় ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের পথে পা বাড়িয়েছিলাম। 



শুকনো মাটির শরীরে নরম রোদ এসে পড়েছে। আমি লাল ধুলোর পথ ছেড়ে আস্তে আস্তে পাশের জঙ্গলে ঢুকলাম। বেশ কিছু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝিঁপোকার দল একটানা ডেকেই চলেছে। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে অন্য একটা শব্দ কানে এল। জলের শব্দ। বুঝলাম, খুব কাছেই নিশ্চয়ই কোন ঝরনা আছে। ঝরনা কোথায় আন্দাজ করে ধীরে ধীরে জঙ্গলের ঝোপঝাড় সরিয়ে এগোচ্ছিলাম। ঘন ঝোপের দেওয়াল সরিয়ে ফাঁকা পাথরের মাঝে বয়ে যাওয়া জলস্রোত চোখে পড়ল। বড় বড় নুড়িপাথর চারদিকে ছড়িয়ে। আমি আস্তে আস্তে পাথরে পা দিয়ে জলের কাছে চলে গেলাম। দুই হাতে আঁজলা ভরে সামান্য জল তুলে নিলাম। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল। আর বেশ ঠান্ডা। সামান্য জল মুখে দিলাম। মনের ভেতরটা এক তাজা অনুভূতিতে ভরে গেল। জল মুখে দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল দৃশ্যটা। জলের পাড়ে একটা বড় পাথর। সেই পাথরের উপর পড়ে আছে কারুর জামাকাপড়। একঝলক দেখে মনে হল সেগুলো কোনও মহিলার কাপড়। খানিক বিব্রত হয়ে যে পথে এসেছিলাম, সেই পথেই ফিরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি, এমন সময় একটি নারীর কন্ঠস্বর কানে এল, 'শুনুন,  এইযে শুনছেন?'


জঙ্গলের দিকে ফিরে তাকালাম। একটা বড় গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে উঁকি মারছে একটা মেয়ের মুখ। তার কোঁকড়া ভিজে চুল দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে সে একটু আগে চান করতে নেমেছিল। সে আমারই আগমনের কারণে তাড়াতাড়ি গিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাড়াহুড়োতে জামা-কাপড়গুলো নিয়ে যেতে পারেনি। আমি তার সমস্যাটা বুঝতে পারলাম। বললাম, 'আমি চলে যাচ্ছি। আপনি একটু বাদে এসে জামা কাপড় গুলো নিয়ে নেবেন।'


মেয়েটা বলল, 'না, না, আপনাকে যেতে হবে না। আপনি কেবল জামা কাপড় গুলো এই বড় গাছের নিচে এসে রেখে যান, প্লিজ। তারপর পেছন ফিরে দাঁড়ান। যতক্ষণ না আমি বলছি পেছনে তাকাবেন না।'


আমি কথা না বাড়িয়ে মেয়েটির নির্দেশমতো কাজ করলাম। কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর মেয়েটার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে বলল, 'এবার আপনি পেছন ফিরতে পারেন।'



মেয়েটির কথায় আমি পেছন ফেললাম। আমি দেখলাম যে ব্ল্যাক টপ, ব্লু জিন্স পড়ে এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হল যে বয়সের দিক থেকে হয়তো সে আমারই সমবয়সী হবে।


'আপনি এখানে কি করছেন?' মেয়েটি জিজ্ঞেস করল।


আমি উত্তর দিলাম, 'এমনি ঘুরতে এসেছি। আর আপনি?'


'আমি এখানে থাকি।'


'এমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝে আপনি থাকেন জেনে খুশি হলাম। তবে এমন ঘন জঙ্গলের মধ্যে এমন একা একা চান করছেন? মানুষ না হোক বুনো জন্তু-জানোয়ারও তো থাকতে পারে!'


মেয়েটা হাসল। 'আমার ক্ষতি কেউ করবে না। আমার চারপাশে রক্ষীরা আছে।'


'রক্ষী? রক্ষী কারা?'


কথাটা বলে আশ্চর্য হয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিলাম। 


মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, 'কেন, এই গাছ, এই পশুপাখি এরাই আমার রক্ষী। কোনও বিপদ হলে গাছ ডালপালা নেড়ে, পাখিরা ডাক দিয়ে সতর্ক করে দেবে।'


'কই আমি যে এলাম! আপনার গাছপালা, পাখিরা তো আপনাকে সতর্ক করল না!'


'তার মানে আপনি নিশ্চয়ই বিপদ নন, সেই কারণেই।' মেয়েটা আবার হাসল।


'বুঝলাম। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করব?'


'করুন।'


'এই জায়গাটা থেকে ঠিক কোন দিকে আপনার বাড়ি?'


'নদীর অন্য পাড়ে যে জঙ্গলটা দেখছেন, সেখানে পশ্চিম দিকে মিনিট দশেক চলতে হবে। তাহলে একটা ভাঙ্গা কেল্লা দেখতে পাবেন। আমি সেখানেই থাকি।'


'কেল্লাতে? আমি শুনেছি যে কেল্লাটাকে স্থানীয় লোকে বেশ এড়িয়েই চলে। ওটা নাকি ভয়ের জায়গা?'


'ভয়ের কিছুই নেই। আমি আমার আত্মীয় পরিজনের সাথে সেখানেই থেকে আসছি বরাবর।'


মেয়েটা কেল্লার প্রসঙ্গ উঠতেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সে কথোপকথন শেষ করে বলল, 'আচ্ছা, আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। এবার আমায় যেতে হবে। আসি তবে?'


'আচ্ছা আসুন। তবে আপনার নামটা জানা হয়নি।'


'আমার নাম রূপা। আপনার নাম?'


'আমার নাম আদিত্য। বাড়ি কলকাতা শহরে। এখানে কয়েক দিনের জন্য ঘুরতে এসেছি। আছি বাজার এলাকায় মিস্টার ব্যানার্জীর পুলিশ বাংলাতে। যদি ওদিকটায় আসেন তবে দেখা করে যাবেন। আবার গল্প করব।'


মেয়েটার মিষ্টি হাসিটা যেন তার পুরো মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সকালের রাঙা রোদের মতো তার হাসি। সে হেসে বলল, 'নিশ্চয়ই। আবার দেখা হবে। আসি।'


মেয়েটা এরপরে জলে নামল। জলের অগভীর অংশের শেওলাধরা সবুজ পাথরে পা রেখে সে ঝরনাটা পার হয়ে গেল। তারপর দ্রুত অন্যদিকের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। 


আমি আরো মিনিটখানেক সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মূল রাস্তায়  ফিরে এলাম। কেন জানিনা, মেয়েটার সাথে দেখা হওয়ার পরে অদ্ভুত একটা শিহরণ মনে জেগে উঠেছিল। এমন নির্জন জায়গায় আমি মেয়েটাকে একেবারেই আশা করিনি।  


মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে পুলিশ বাংলোর সামনে পৌঁছে গেছি, তা খেয়ালই নেই।



সন্ধ্যেবেলা জেঠু ফিরতেই দিনেরবেলার অদ্ভুত ঘটনাটা বললাম। জেঠু শুনে বললেন, 'স্ট্রেঞ্জ! মেয়েটা বলল যে কেল্লায় বাস করে। কিন্তু সেখানে তো মানুষজন কেউ থাকে না। তাহলে মেয়েটা বা ওর পরিবার থাকে কিভাবে? ব্যাপারটা নিয়ে একটা অভিযান করলে মন্দ হবে না, কী বলো?


আমি দেখলাম দারুন একটা সুযোগ জেঠুর অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হওয়ার। আমি বললাম, 'আপনি পুলিশ ফোর্স নিয়ে যখন কেল্লায় যাবেনই, তখন আমাকেও সঙ্গে নিন না। আমি তো এইসব রহস্য-রোমাঞ্চ বেশ পছন্দ করি।'



ব্যানার্জী জেঠু উত্তর দিলেন, 'আমাদের পুলিশি অভিযানে সাধারণ মানুষকে নিয়ে যাওয়া বারণ, কারণ সাধারণ মানুষ যে কোনও বিপদে পুলিশের মত আত্মরক্ষা করা নাও জানতে পারে। তাছাড়া আমরা একটা করব সেটা আমাদের ডিউটি। অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচবার প্রশিক্ষণও আমাদের আছে।'




'আমি বুঝেছি সেটা আপনাদের ডিউটি। কিন্তু আমি একজন অ্যাডাল্ট এবং আমি ক্যারাটে জানি। নিজের আত্মরক্ষা আমি কিছুটা হলেও করতে পারব। সুতরাং আপনাদের এই অভিযানে আমাকে সঙ্গী করে নিন, প্লিজ।'



জেঠু কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, 'ঠিক আছে। তুমি আসতে পারো আমাদের সাথে। কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেবে না। একা একা কোথাও গায়েব হয়ে যাবে না। আমাদের সাথেই থাকবে, বুঝেছ?'



আমি মাথা নাড়লাম। জেঠুর আরও যোগ করলেন, 'এই অভিযানের জন্য দেরি করব না। দেরি করলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। হয়তো কোন অপরাধী দল এখানে ঘাঁটি গেড়েছে। দেরি করলে তারা দলবল নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। অতএব, আগামীকাল রাতেই কেল্লায় হানা দেওয়া হবে।'



এবার পরের দিনের রাতের ঘটনায় আসি। আমরা সবাই মিলে জঙ্গলের রাস্তায় দুটো জিপে করে চললাম। শীত বেশ ভালোই পড়েছে। ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় স্নান করছে রাতের জঙ্গল। আমরা আস্তে আস্তে জোরালো টর্চটা জ্বালিয়ে জঙ্গলের পথে পা বাড়ালাম। ছোট নদী টা পেরিয়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকলাম। সবাই প্রায় গায়ে গায়ে চলেছি, তবুও অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে এই সীমাহীন অন্ধকারের মাঝে বুঝি আমি একা।



এমনি চলতে চলতে এক সময় আমি একটা কিছু অনুভব করলাম। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। আমাদের পথ চলার সাথে সাথে যেন কিছু নড়াচড়া করছে। কিন্তু সত্যিই কি কিছু নড়াচড়া করছে? নাকি আমার মনের ভুল? শব্দের উৎস খোঁজবার চেষ্টা করলাম। শব্দটা চারপাশ থেকে আসছে। চাপা, খসখস শব্দ। যেন কেউ বা কারা এই গভীর জঙ্গলে আমাদের ঘিরে ফেলতে চাইছে। শব্দটা কখনও কাছে, কখনও দূরে। আশেপাশের বড় বড় দৈত্যের মতো গাছগুলোতে শব্দটা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে বলে মনে হয়। 



আমার মনে হল যে শব্দটা বোধহয় আরও অনেকেই শুনেছে। কারণ আশেপাশের পুলিশ কর্মীরাও সচকিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাদের টর্চের আলো অন্ধকার কেটে কেটে যেন কোনও অজানা শত্রুকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। আমরা সবাই যখন ভাবছি যে এরপরে কী ঘটতে পারে, ঠিক সেই সময়ে ঘটনাটা ঘটল। আমার আর ব্যানার্জী জেঠুর সামান্য আগে আগে চলতে থাকা পুলিশ কর্মীর ওপর যেন বিশাল বড় কালো ভাল্লুক ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পরমুহূর্তেই পুলিশটাকে একরকম বগলদাবা করে নিয়ে সেই ভাল্লুকের মতো প্রাণীটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠে গেল। আমি ও পুলিশদের সবাই সভয়ে ওপরের দিকে তাকালাম। আমরা যা দেখলাম তাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। বিশাল বিশাল লোমশ প্রাণীরা গাছের ডাল জড়িয়ে ধরে সরীসৃপের মতো ধীরে ধীরে আমাদের দিকে নেমে আসছে। তাদের চোখগুলো গোল আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। তাদের মুখের চাপা গর্জন শুনে যেন আমাদের ভেতরের হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল। 



যুদ্ধ শুরু হল। পুলিশের রাইফেলের গর্জে ওঠার শব্দ পেলাম। ব্যানার্জী জেঠু চেঁচিয়ে উঠে বললেন, 'সবাই গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছিয়ে এসো।'



আমি একরকম পেছন ফিরে পালাচ্ছিলাম। কিন্তু বিপদ যেন আমার পেছন পেছন আসছিল। আমার সামনের গাছ থেকে নেমে এল সেই অতিকায় ভয়াল প্রাণীগুলোর মধ্যে একটা। আমি প্রাণীটার মুখ লক্ষ্য করে সজোরে একটা কিক মারলাম। প্রাণীটার তাতে ন্যূনতম ক্ষতি হল বলে মনে হল না। সেটা বিকট একটা গর্জন করে উঠল। তারপর একটা থাবা দিয়ে আমার মুখ লক্ষ্য করে আঘাত করল। আমি সেই দানবের উঁচু হয়ে থাকা থাবাটা দেখতে পেয়েছিলাম। মাথা সরিয়েও নিতে গেছিলাম। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। একটা তীব্র ধাক্কা এসে লাগল মুখে। সাথে সাথে মনে হল যেন তীব্র ধারাল কিছু কপালের  চামড়া ছুঁয়ে চলে গেল। সেই আঘাতের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে দানবটার অন্য হাতটা জোরে এসে লাগল আমার বুকে। ছিটকে পড়ে গেলাম। জোরে আঘাত এসে লাগল আমার বুকে। কয়েক মুহূর্ত পরেই চোখে অন্ধকার দেখলাম। জ্ঞান হারানোর আগে কারুর যেন  ফিসফিস করে কথা শুনতে পেলাম, 'ওকে মেরো না। ওকে নিয়ে চলো।'



                        


কতক্ষণ পরে আমার জ্ঞান ফিরেছিল জানি না। শুধু জানি জ্ঞান ফেরার পরে মাথাটা পাথরের মতো ভারী বলে মনে হয়েছিল। মাথা তোলার চেষ্টা করেও পারলাম না। আস্তে আস্তে কপালে হাত দিলাম এবং ভয়ানক যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম। একই সাথে অনুভব করলাম যে কেউ একজন কপালে আঘাতের জায়গাতে কিছু শুকনো পাতা ও কাপড় বেঁধে রেখেছে। 



ওঠবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আমি চিৎ হয়ে পড়েছিলাম। মাথার ওপরে খোলা মেঘমুক্ত আকাশ। অগুনতি তারাদের দল প্রোজ্জ্বল হীরের মতো রাতের গয়না হয়ে আকাশে ছড়িয়ে আছে। নিজের বাড়ির ছাদ হলে নিশ্চিন্তে এমন মায়াময় আকাশ দেখেই রাতটুকু কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু পরিস্থিতি এখানে অন্য। সময়টা বিপদের। আমি কোথায় আছি, কাদের মাঝে আছি, কিছুই জানি না। 



সেই বীভৎস দানবদের সাথে পুলিশকর্মীদের যে লড়াই হয়েছিল, তা কি শেষ হয়েছে? পুলিশরা কি সবাই অক্ষত, জীবিত? তাদের ছোঁড়া গুলির আঘাতে কি এই ভয়ানক দানবগুলো জখম বা নিহত হয়েছে? এইসব নানান প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা খাচ্ছিল। 



হাত-পা সামান্য নাড়াচাড়া করে বুঝলাম যে সেগুলো ঠিকঠাকই আছে। কেবল বুকের কাছটা বেশ জোরে লাগলো। আস্তে আস্তে একদিকে কাত করে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলাম। সামান্য দূরে বেশ বড় পাঁচিল। পাঁচিলের আকার দেখে মনে হল ওপরের অংশটা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। এটা কোথায়? কষ্টেসৃষ্টে মাথাটা এবার ডানদিকে কাত করলাম। একটা বিশাল বড় কেল্লার অবয়ব চোখে পড়ল। তবে মনে হল কেল্লার সেই সুদিন আর নেই। এখন সেটা ভগ্নস্তূপ। এমন শুনশান জায়গায় এভাবে মুক্তাকাশের নিচে পড়ে থাকার মানেই হয় না৷ মাথা না চললেও, দুহাতে ভর দিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করলাম। 



ঠিক সেই সময়ে অন্ধকার ফুঁড়ে একটা নারীকন্ঠ শোনা গেল, 'উঠবেন না। চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আপনার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন।'



আমার কণ্ঠস্বরটা চেনা চেনা লাগলো। সকালে দেখা হওয়া সেই মেয়েটা নাকি? কী যেন নাম বলেছিল? রূপা? আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, 'আপনি রূপা না?'



মেয়েটার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলার শব্দ কানে এল। বলল, 'হ্যাঁ আমি সেই।'



আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'আমি... আমি এই কেল্লায় এলাম কিভাবে?'



'আপনাকে নিয়ে আসা হয়েছে।'



'কেন?'



'কারণ আপনি যে পরিমাণ জখম হয়েছিলেন তাতে বনের মধ্যে আপনাকে একা ফেলে যাওয়াটা আপনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার সমান।  তাই আপনাকে আমরা নিজেদের মাঝে নিয়ে এসেছি।'



'আপনারা বলতে ওই ভয়ানক দেখতে প্রাণীগুলো! তারা আপনার কেউ হয় নাকি?'



'হ্যাঁ, ওরা আমার পরিবার। আমিও রাতের বেলায় শিকার করার সময় ওদের মতো হয়ে যাই!'



'আপনারা কি আদৌ মানুষ? নাকি কোনও দানব বা প্রেত অশরীরী?'



'না, মানুষ আমরা নই।'



'তবে?'



'জঙ্গল বড় রহস্যময় জায়গা আদিত্য। পৃথিবীর বিভিন্ন জঙ্গলে এখনও কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে যার খোঁজ বিজ্ঞানীরা আজও পায়নি। যেমন এই জঙ্গলের অতীত ইতিহাস মানুষ আজও জানে না। হাজার বছর আগে এসব জঙ্গল ছিল প্রকৃতির এক বনদেবীর হাতে। বনদেবী একদিকে যেমন জঙ্গলের প্রাণীদের শাসন করতেন তেমনি অন্যদিকে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতেন। দেবী খেয়াল করলেন যে মানুষ বনের অন্য পশুদের থেকে দুর্বল হলেও তার মস্তিষ্ক বেশ সচল। কিন্তু শুধু মস্তিষ্ক দিয়ে তো জঙ্গলের লড়াই জেতা যায় না। তার জন্য দরকার শারীরিক শক্তি। সেই সময় এই অংশে ছিল ভাল্লুকদের রাজত্ব। বনদেবী এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। তিনি তাঁর গুপ্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাল্লুক ও মানুষের শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত প্রাণীর সৃষ্টি করলেন। তৈরি হল ভাল্লুক মানব। এক বিচিত্র প্রাণী যারা ভাল্লুক এর মতো আসুরিক শক্তির অধিকারী, আবার মানুষের মত বুদ্ধি রাখে। ক্রমে ভাল্লুক মানুষরা এই বনের রাজা হয়ে উঠলো। কিন্তু তাদের এই রাজত্ব বেশিদিন সইল না। সাধারণ মানুষ ক্রমেই সভ্য হচ্ছিল। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে তাদের অস্ত্রশস্ত্র উন্নত হয়েছিল। প্রায় হাজার বছর আগে ভাল্লুক মানুষদের সাথে সাধারণ মানব সেনা দলের এক তীব্র সঙ্ঘাত হয়। আমি গল্প শুনেছি যে সাধারণ মানুষরা প্রচুর পরিমাণ ধারালো অস্ত্র ও আগুনের মশাল নিয়ে কেল্লা ঘিরে ফেলে। লড়াইয়ে প্রচুর মানুষ মারা যায়। অনেক ভালুক মানুষেরও মৃত্যু হয়। কিছু ভালো মানুষ বনের আরো গভীরে পালিয়ে যায়। ভালুক মানুষের উৎপাত থেকে জঙ্গলকে রক্ষা করতে মানুষ সাময়িকভাবে এই কেল্লায় বসবাস শুরু করে। কিন্তু কালক্রমে ইতিহাসের চাকা ঘুরতে ঘুরতে এই কেল্লা ও জঙ্গল সভ্য মানুষ ত্যাগ করে। ফলে ভালুক মানুষেরা ফিরে আসে। তারা এসে ভগ্নপ্রায় কেল্লায় বসবাস শুরু করে। তারাই আমার পূর্বপুরুষ।



এই জঙ্গল তার অপার সৌন্দর্য ও নির্জনতা নিয়ে আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যতদিন এই জঙ্গল থাকবে ততদিন আমরাও থাকব।'



'আপনারা তো দীর্ঘ সময় ধরে এখানে আছেন আশেপাশের উপজাতির মানুষজন আপনাদের কথা জানে না?'



'জানে তারা সবাই। এই জঙ্গলে আমাদের কোনও না কোনও সময় তারা দেখেছে। তাদের অনেকে জোর করে সাহসিকতার প্রমাণ দিতে গিয়ে আমাদের হাতে মারা পড়েছে। অনেকগুলো অপমৃত্যুর পরে স্থানীয় মানুষজন এই জঙ্গলকে এড়িয়ে চলে। তারা আমাদের ডাকে 'ভূতিয়া ভালু' নামে।'



'ভূতিয়া ভালু! বাঃ, আমিও এরপর থেকে আপনাদের এই নামেই ডাকব। আচ্ছা একটা কথা মাথায় এল। আপনাদের এই অদ্ভুত প্রাণীরা এই জঙ্গলে হাজার বছর ধরে আছেন। এতদিনে আপনাদের সংখ্যাটা তেমন বাড়ল না কেন?'



'তার কারণ আমরা মানুষের মতো বেহিসেবি বংশবৃদ্ধি করি না। যেহেতু আমরা আমিষাশী, তাই বনের জন্তু-জানোয়ার মেরে খাওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই। যেহেতু আমরা অর্ধেক মানুষ তাই মানুষের মাংস-রক্ত খেতে আমাদের অস্বস্তি হয়। আমাদের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে বনের নিরামিষাশী প্রাণীর সংখ্যা কমতে কমতে শূন্য হয়ে যাবে। তখন খাদ্যের সন্ধানে আমাদের জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়েও হানা দিতে হবে। সেটা কাম্য নয়। তাই আমরা চট করে সন্তানের জন্ম দিই না। অবশ্য জন্ম না দেওয়ার আরও একটা কারণ আছে। ভূতিয়া ভালুদের মধ্যে যারা প্রবীণ তারা অদ্ভুত এক হতাশায় ভোগেন। তাদের মনে হয় যে আমাদের এই রূপ এক ধরনের অভিশাপ। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তন নয়। কেউ কেউ এমনও চান যে তাদের প্রজন্মের সাথে সাথেই এই অদ্ভুত প্রাণী পৃথিবী থেকে মুছে যাক। ফলে সন্তানের জন্ম দিতে তাদের প্রবল অনীহা।'



'হুম সবই বুঝলাম। তা আমাকে নিয়ে কী করবেন বলে ঠিক করলেন?'



'আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আপনি একটু সুস্থ হয়ে গেলেই আপনাকে জঙ্গলের ধারে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকে আপনি লোকালয়ের দিকে রওনা হতে পারেন। তবে ছেড়ে দেওয়াটা নির্ভর করবে একটা শর্তের ওপর।'



'কী শর্ত?'



'আপনি আমাদের অস্তিত্ব সভ্য সমাজের কাছে আগামী কয়েক বছর প্রকাশ করবেন না।'



'বেশ করব না। কিন্তু তাতে কি আপনারা বাঁচবেন? আমাকে আক্রমণের সাথে সাথে আপনারা পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন। আমি কিছু না বললেও পুলিশ কি আপনাদের ছেড়ে দেবে ভেবেছেন?'



'সে কথা আমরা ভেবে দেখেছি। আমরা জানি যে পুলিশ খুব তাড়াতাড়ি আপনার খোঁজে এবং আমাদের সাথে লড়াইয়ের জন্য আরও একটা বড় দল নিয়ে এই জঙ্গলের মধ্যে আসবে। খুব সম্ভবত তারা এই কেল্লাতেও হানা দেবে। তাই আমরা ভোর হওয়ার আগেই এই কেল্লা ছেড়ে আরো গভীর জঙ্গলের দিকে চলে যাব। আপনার কাছে অনুরোধ আমাদের দুজনের এই কথোপকথন এবং আমাদের এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর পুলিশ বা অন্য কাউকে আপনি জানাবেন না।'



'ঠিক আছে। জানাব না।'



'বেশ, অনেকক্ষণ কথা হল। এবার আপনি বিশ্রাম নিন।'



মেয়েটা আবার আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিশে গেল। আমারও আর শারীরিক শক্তি ছিলনা। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। 



এরপরে যখন চোখ খুললো তখন গনগনে রোদের আঁচ অনুভব করলাম। রূপা যে কী আয়ুর্বেদিক গাছগাছরা দিয়ে আমার চিকিৎসা করেছিল তা জানি না। কিন্তু মাথাটা এখন অনেক হালকা লাগল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। শরীরে মনে হল একবিন্দুও শক্তি নেই। তবু বাঁচবার প্রবল ইচ্ছে আমাকে চঞ্চল করে তুলল। 



কেল্লার ভাঙাচোরা সদর তোরণ পেরিয়ে জঙ্গলের ঘন ঘাস ও পাহাড়ি ফুলের গাছ পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। কিছুক্ষণ পরে পরেই গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল। এমন করে কত সময় কাটল জানিনা। হঠাৎ মানুষজনের চাপা কথাবার্তা শুনে আমার কান দুটো সজাগ হয়ে উঠলো। আমি শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। যাদের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম তারাও এতক্ষণে ঘাসের মধ্যে দিয়ে আমার হাঁটার শব্দ টের পেয়েছিল। চলতে চলতে হঠাৎ সামনের ঝোপটার কাছে মনে হল কী যেন একটা দুলছে। 



পরমুহূর্তেই ঝোপের আড়াল থেকে একটা বন্দুকের নল বেরিয়ে এলো। বন্দুকটির মালিক বলে উঠল, 'খবরদার! নড়লেই গুলি করে দেব।'



আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। কয়েক সেকেন্ড পরে বন্দুকের মালিক আমার দিকে বন্দুকটা তাক করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলেন। কয়েক সেকেন্ড তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, 'আদিত্য তুমি!'



আমার দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল। তবে গলার স্বর শুনেই বুঝেছিলাম যে আমার সামনে বন্দুক উঁচিয়ে থাকা ভদ্রলোক ব্যানার্জী জেঠু ছাড়া আর কেউ নন। তবে জেঠু আর কিছু বলবার আগেই মাথার ভেতরটা কেমন যেন ঝনঝন করে উঠলো। আমি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম।



এরপরে যখন চোখ খুলি তখন আমি ব্যানার্জী জেঠুর বাড়ির খাটে শুয়ে। গায়ে অসম্ভব ব্যথা। গা বেশ গরম। কয়েকদিন জ্বরে ভুগে অবশেষে সুস্থ হলাম। মাথা কাটা দাগটাও ততদিনে শুকিয়ে এসেছে। এর মধ্যেই বাড়িতে খবর গিয়েছিল। আমার বাবা কলকাতা থেকে রাতারাতি ছুটে এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। না, এরপর আর রংপুরে থাকা হয়নি। বাবার সাথে কলকাতা ফিরে এসেছিলাম।"



এইটুকু বলে আদিদা কফির কাপে চুমুক দিল। 



আমি বললাম, "পুলিশ তোমাকে ওই ভূতিয়া ভালু সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?"



"করেছিল। ব্যানার্জী জেঠু কলকাতা ফিরে আসার পরেও দুবার ফোন করেছিল। আমি প্রতিবারেই একই কথা বলেছিলাম। বনের মধ্যে কোনও দানবের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরের দিন জ্ঞান ফিরতে বনের মধ্যে এলোমেলো পায়ে চলতে চলতে পুলিশের দলটাকে খুঁজে পাই।




ব্যানার্জী জেঠু এই প্রশ্নও করেছিলেন যে মাথায় আয়ুর্বেদিক ওষুধ আর কাপড়টাকে বেঁধে দিল। আমি খুব স্পষ্টভাবে উত্তর দিয়েছিলাম যে আমার জানা নেই। আমি গোটা রাত অজ্ঞান ছিলাম। জেঠু আমাকে আর বেশি ঘাঁটাননি।"



এইটুকু বলে আদিদা একটু চুপ করল। 



আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি রংপুরে আর কখনও যাওনি?"



আদিদা বলল, "না, বাড়ি থেকে বাবার স্পষ্ট বারণ ছিল।" তারপর আদিদা হেসে যোগ করল, "অবশ্য মনে মনে এখনও যাই। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই আমি যেন এখনও কোনও পূর্ণিমার রাতে জঙ্গলের সেই ছোট্ট ঝরনার পাশে পাথরের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছি। আর গাছপালার আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ্য করছে একটি মেয়ে। নিঃশব্দে মিষ্টি করে হাসছে সে। তার হাসিটা ঠিক যেন জ্যোৎস্না গলানো রুপোর মতো।"



                 [সমাপ্ত]



45 views0 comments

Comments


bottom of page