top of page
Search

বিরতি থেকে ফিরে ।। অল্প কথার গল্প ।। চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি

agantukpotrika

মাতৃঋণ

চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি




               (১)



আজ ডক্টর রাজীব সান্যালের মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেল। বাবা সাত বছর আগেই গত হয়েছেন। এখন মাও চিরশান্তির ঘুমের দেশে চলে গেলেন। মায়ের কাজ উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন ছিল। আস্তে আস্তে সবাই একে একে বিদায় নিচ্ছেন। বিকেলবেলা ছোট মামারাও তাঁদের নিজেদের বাড়ি চলে গেল। ফাঁকা বাড়িটাতে শুধু রয়ে গেল ডক্টর রাজীব ,তার স্ত্রী মঞ্জরী, ছেলে সোহম ও দিনরাতের কাজের দিদি মিতালী। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর রাজীব সদ্য চলে যাওয়া মায়ের ঘরে গিয়ে বসল ।মায়ের ছেড়ে যাওয়া ঘরটায় এখনো যেন মায়ের গায়ের গন্ধটা ঘুরে ফিরে আসছে ।মঞ্জরীর সাথে মায়ের সম্পর্কটা বরাবরই ভাল ছিল। ভালবাসায় মোড়া একটা জীবন ছিল রাজীবের। আজ মায়ের অনুপস্থিতিতে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। টেবিলের ওপর রাখা মায়ের স্মিতমুখের ছবিটা। ছবিটা দুহাতে তুলে নিয়ে মাকে  ছোবার ব্যর্থ চেষ্টা। হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলো মায়ের আলমারিটার একটা পাল্লা ঠিক ভাবে লাগানো নেই। সোনাদানা তো  ভেতরে নেই। তাই বোধহয় মঞ্জরী ঠিকভাবে আটকায়নি ।উঠে গিয়ে পাল্লাটা বন্ধ করতে যেতেই চোখ আটকালো একটা পুরোনো ডায়েরির ওপর। রাজীব ডায়েরির পাতা উল্টাতে শুরু করল।( ২)




গ্রামের মেঠো পথ ধরে রাজীবের বড় গাড়িটা এগোচ্ছিল। সাথে মঞ্জরী আছে। গাড়ি চালাচ্ছে অজয় ,রাজীবের বহুদিনের পুরনো ড্রাইভার। কিন্তু কিছুটা পথ এগোতেই বিপত্তি ।বড়সড় চওড়া গাড়িটা কিছুতেই আর সামনে এগোতে পারছে না। রাস্তাটা যে বড়ই সংকীর্ণ ।কিন্তু রাজীবকে যে কোন প্রকারে সামনে এগোতেই হবে ।অজয়কে গাড়িতেই অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রাজীব ও মঞ্জরী ।মঞ্জরী অনভ্যস্ত পায়ে রাজীবের সাথে হাঁটতে থাকে ।এই অজ পাড়াগাঁ যার নাম রাঙ্গামাটি, এখানে আসার কারণটা এখনো জানেনা মঞ্জুরী। শাশুড়ি মায়ের যেদিন কাজ ছিল সেদিন রাতেই রাজীব তাকে জানায় যে তারা খুব তাড়াতাড়ি রাঙামাটি যাচ্ছে ।আগে রাঙ্গামাটির নাম মঞ্জরী কখনো শোনেনি। তড়িঘড়ি রাজীবের এখানে আসার কারণটাও  মঞ্জরীর অজানা। যাইহোক, শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে অজপাড়াগাঁ রাঙ্গামাটি। রাজীব ও মঞ্জরী  সাধাসিধে ,ছিমছাম পোশাক পরা। কিন্তু তবুও শহরের চাকচিক্য তাদের মধ্যে বর্তমান। গাঁয়ের কৌতুহলী চোখগুলো তাদের দিকে তাকিয়েছিল। রাজীব একটি মধ্যবয়সী মহিলাকে জিজ্ঞেস করে আমিনা খাতুন এর বাড়ি কোথায়। মহিলাটি বেশ অবাক চোখে তাদের জরীপ করে। তারপর বলে সামনে সোজা কিছুটা পথ হেঁটে গেলেই একটি পুরনো মসজিদ পড়বে। তার গায়ে লাগোয়া বাড়িটাই আমিনা খাতুনের। নির্দিষ্ট পথে চলতে থাকে ওরা। মিনিট পনেরো হাঁটার পর মসজিদটি নজরে আসে। পাশেই একটি অতি পুরনো বাড়ি।বোঝা যায় বাড়িটির বহুকাল মেরামত হয়নি। ভাঙাচোরা  দেওয়ালে লতাগুল্ম  গজিয়ে আছে। ভাঙা ইটগুলো দাঁত বার করে হেসে যেন বাড়িটার করুন অবস্থাকে ঠাট্টা করছে ।বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় দু তিনটে বাচ্চা ছেলে মেয়ে বসে খেলা করছে। এরি মধ্যে একটি মেয়ে যে একটু বয়সে বড় মনে হল, তাকে ডেকে নিল রাজীব।




---" আমিনা খাতুন কি এখানে থাকেন? ওনাকে একটু ডেকে দেবে ?"



---"আপনি দাঁড়ান। আমি ডেকে দিচ্ছি ।"


এই বলে মেয়েটি "দাদি" "দাদি" বলে ডাকতে ডাকতে বাড়ির খোলা ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। রাজীব আর মঞ্জরী বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। খানিকটা সময় পরে বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে একটি অশীতিপর বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। হাতে লাঠি। বোঝাই যাচ্ছিল একা একা চলতে পারেন না। চোখের ওপরে বাঁহাত টা রেখে ঠাওর করতে চাইলেন তার ভাঙাচোরা দোরে কাদের পদার্পণ ঘটলো ।বৃদ্ধাকে দেখেই রাজীব তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। চোখের ইশারায় মঞ্জরীকেও প্রণাম করতে বলল। মঞ্জরীও করল। 



---" তোমরা কে গো বাছা? তোমাগো তো চিনি না।"



---" আপনি আমাদের চিনবেন না ।তবে সেদিন সদ্যোজাত  আমাকে আপনি মাতৃস্নেহ দিয়েছিলেন ।সেদিন আপনি আমায় না বাঁচালে  আজ হয়তো আমার অস্তিত্বই থাকত না। আমি আপনার কাছে চির ঋণী।"



 বৃদ্ধা অবাক, ঘোলাটে চোখে দম্পতির পানে চেয়ে রইল ।কিছুই যে তার বোধগম্য হচ্ছে না।---" কিছুই যে বুঝতেছিনা বাবা। বুঝাইয়া কও।"




 বৃদ্ধা আমিনা খাতুন একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাচ্চা মেয়েটি একটা মোড়া এনে তাকে সেখানে বসায়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা  তার নেই।



---" আপনার মনে পড়ে আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে আপনি সদর হাসপাতালে ভর্তি  হয়েছিলেন। তখন আপনি সন্তানসম্ভবা ।"



আস্তে করে বৃদ্ধা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।



---" আপনি তখন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আপনার পাশের বেডে আরেকজন মাও একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় ।সেই মা তার সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে অক্ষম হয় তার নানা বিধ অসুস্থতার কারণে। শিশুটি খিদের জ্বালায় কাতরাতে থাকে। আপনি সেই মা যিনি জাতপাতের তোয়াক্কা না করে সেই অজানা অচেনা হিন্দু ঘরের শিশুটিকে স্তন্যপান করান ও জীবন দান  দেন।"



আমিনা খাতুন সজল নেত্রে রাজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাজীব হাঁটুগেড়ে  মাটিতে বসে বৃদ্ধার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে নেয় ।




---"কিছুদিন আগে আমি আমার মৃতা মায়ের লেখা ডায়েরি পড়ে সবটা জানতে পারি। আপনার ঋণ আমি এই জীবনে শোধ করতে পারবো না। কাকতালীয়ভাবে যে সদর হাসপাতালে আপনি ও আমার মা ভর্তি ছিলেন, বর্তমানে সেখানকার  আমি ডাক্তার।  আপনার ঠিকানা  পুরনো ফাইল ঘেঁটে আমি খুঁজে পেয়েছি। আর তাই তারপর এখানে চলে এলাম। আপনার ছেলে হিসেবে যতটা সম্ভব আমি আমার কর্তব্য করব। আপনার বাড়িতে কারা থাকেন ?তাদের একটু ডাকুন ।"



বৃদ্ধা বলল ,"কেউ তো থাকে না। আমিতো একাই এখানে থাকি বাবা ।"



---"কেন? আপনার ছেলে?


সে কোথায়? সে তো আমারি বয়সী হবে।"



---" সে তো নাই বাবা।"



 ---"মানে?"



---" হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার সাত দিনের মাথায় সে আমায় ছেড়ে আল্লাহর কাছে চইলা যায়।"


 কান্নায় বুজে আসে বৃদ্ধার গলা।  পুত্রসন্তানের মৃত্যুশোক এখনো দগদগে হয়ে আছে তার হৃদয়ে।



---" আপনি কাঁদবেন না‌। আমি তো আপনারই আরেকটি সন্তান। আপনার সকল দায়িত্ব এখন আমার ওপর।চলুন বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে নিন। আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে থাকবেন।"




আমিনা খাতুন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে রাজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে। একি তার হারিয়ে যাওয়া পুত্রসন্তান না কোনো ফেরেস্তা? রাজীব আলতো হাতে তার মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয়। মঞ্জরী স্বামীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page