top of page
Search

শ্যামাপূজা সংখ্যা ।। অল্প কথার গল্প ( অতিপ্রাকৃতিক ) ।। বুমা ব্যানার্জী দাস

agantukpotrika

পরিশোধ


বুমা ব্যানার্জী দাস




-ও কত্তা কিছু হারালো নাকি? খুঁজছোটা কী? - অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে লাখন। সন্ধে হব হব। বড় বটগাছটার নীচে এর মধ্যেই ঝুপসি অন্ধকার। তার নীচে উবু হয়ে বসে একটা লোক কী যেন খুঁজছে মনে হল। অদ্ভুত ব্যাপার। এ গাঁয়ে লোকটাকে আগে কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারলনা লাখন। এই তো ছোট্ট গ্রাম তাদের, কটাই বা ঘর। বাইরের লোক বিশেষ আসেওনা এদিকে। মূল শহর থেকে বেশ দূরে হলে যা হয় আর কী। আদিতে এ এলাকা ছিল নিষাদদের, সে কয় হাজার বছর আগে সেসব হিসাব জানেনা লাখন। শুনেছে তাদের পূর্বপুরুষরা নিষাদ ছিল, শিকার করে খেত। এখন চাষ বাস, ছোট খাট ব্যবসা এইসব করে পেট চলে তাদের। কখনও বা চলেনা। বড় গরীব এসব দিক। সে যাক, এই বুড়ো এলো কোথা থেকে। আবার ডাক পাড়ে লাখন, এবার হিরওয়াতিতে। সত্যি তো, তাদের আদি ভাষা কজনই বা বোঝে - বলি ও কত্তা কী হচ্ছে ওখানে? - বুড়ো শুনতে পেল বলে মনে হল না। ঝুঁকে পড়ে দুই হাতে ঘাস সরিয়ে সরিয়ে কী খুঁজছে কে জানে। পয়সা টয়সা পড়ে গেছে হবে। 



দু পা এগিয়ে আস্তে করে বুড়োর গায়ে হাত রেখে প্রায় লাফিয়ে ওঠে লাখন। কী গরম গা রে বাবা। আগুন ছুটছে যেন। জ্বরে ভোগা নাকি ? চমকে উঠে ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মত টান হয়ে দাঁড়ায় বুড়ো। চোখ দুটো ধক ধক করছে যেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লাখন। পাকা চুল দেখে বুড়ো ভেবেছিল বটে, তবে চেহারায় একেবারেই বুড়োদের মত নয়। একটা পাহাড় যেন দাঁড়িয়ে আছে বটতলার আলো আঁধারে। সাপের ফণার মত ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সাদা চুলের রাশি কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। কপালে আড়াআড়ি তিনটে দাগ কাটা। লাখন ভাবে তাহলে নিশ্চয়ই কোন সন্ন্যাসী হবে। ওদের কপালে এরকম দাগ দেখেছে কখনও কখনও। তবে ঠিক তাদেরও মত মনে হচ্ছেনা একে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক তীব্র। এক কাঁধের উপর দিয়ে সাদা চাদর কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। হাত দুটো যে ভীষন শক্তিশালী তাতে কোন সন্দেহ নেই। হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ধুতি নেমেছে। পায়ে খুব অদ্ভুত দেখতে এক জোড়া জুতো। দেখে মনে হচ্ছে কাঠের তৈরী। নিজের অজান্তেই কয়েক পা পিছিয়ে যায় লাখন। তার থেকে অন্তত এক হাত বেশি লম্বা লোকটা।


প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে - কে তুমি, মানে আপনি?


লোকটার চোখে তীব্রতা যেন হঠাৎ কমে আসে। ফুটে ওঠে একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। নিজের মনে বিড়বিড় করে ওঠে - কোথায় যেতে পারে?


- এই রে, এ নির্ঘাত পাগল - নিজের মনে লাখন ভাবে। বাড়ি হারিয়ে ফেলেছে বোধহয়।


সেটাই জোরে জিজ্ঞেস করে - বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না?


বিরক্তিতে  ভয়ানক ভ্রূকুটি করে ওঠে বুড়ো। - আহহ, বাড়ি কেন খুঁজব? - এবারে বিড়বিড় নয়, বেশ মেঘ ডাকা জোরালো গলায়।


লাখনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধ , ভালো করে দেখে তাকে, তারপর নিজের মনে বলে ওঠে - ঠিক জায়গাতেই তো এসেছি, এখানেই তো থাকার কথা।


- কী থাকার কথা যদি বলেন - মিনমিন করে বলে লাখন। এবার তার একটু ভয় ভয় করছে।



আবার বটতলার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় বুড়ো - সে তুমি বুঝবে না -  তারপর হঠাৎ কেমন ছটফট করতে করতে বলে - বড় অন্যায়, বড় অন্যায় করেছিলাম তার সাথে। আজ তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষমা না চাইলে আমার যে মুক্তি নেই। আর কতদিন এভাবে ঘুরে বেড়াতে হবে - শেষের শব্দগুলো কেমন হাহাকারের মত শোনায়। লাখনের গা কেমন শিরশির করে ওঠে।


ধীরে ধীরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে বৃদ্ধ মানুষটি। ওই পাহাড়ের মত শরীর নিয়েও কেমন অসহায় দেখাচ্ছে তাকে এখন। মানুষটির বাঁ কাঁধের উপরটা এখন দেখতে পাচ্ছে লাখন। সেখানে সুস্পষ্ট একটি দাগ। এই দাগ তো তার খুব চেনা। তারা বংশগত ভাবে নিষাদ। এ দাগ চিনবে না সে? দিনের পর দিন ধনুকের ছিলার ঘষা লেগে তৈরী হয় এই দাগ। কিন্তু আজকাল তারাও আর অত তীর ধনুক ব্যবহার করেনা। যদিও তাদের গ্রামের সব ছেলেই যেন তীর ছোঁড়ার জন্মগত ক্ষমতা নিয়ে আসে। প্রত্যেকেরই নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা, আর প্রত্যেকেরই - যাক সে কথা।


এই বুড়োকে নিয়ে এখন কী করা যায়। ওকি মানুষটার দুই চোখ বেয়ে যে ঝরঝর করে জল পড়ছে। সেই তীব্র ভিতর পর্যন্ত দেখে নেওয়া দৃষ্টি মুছে গিয়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে কী অপরিসীম অসহায় ভাব। লাখন আবার হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। এবার আর্তস্বরে কান্নায় ভেঙে পড়ে ওই মস্ত শরীরটা - ক্ষমা করো, ক্ষমা করো। - মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে লাখনের। 




নির্ঘাত জ্ঞান হারিয়েছিল। অনেকক্ষণ পর যখন উঠে বসল লাখন, চারিদিক বেশ অন্ধকার। গাছতলা ভোঁ ভাঁ। কেউ কোথ্থাও নেই। দূর থেকে বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। কাল তাদের মহা উৎসব। বছরের এই একটা দিন তারা সব নিষাদ মিলে পাশের খন্দসা গ্রামের মন্দিরে যায়। সেখানে তীরন্দাজী হয় সমস্ত দিন। শুনেছে এরকম মন্দির নাকি সারা দেশে একটাই আছে। সেই কবে যেন তাদের বীর গুরুদক্ষিণা দিয়েছিল নিজের বুড়ো আঙুল কেটে। গুরু দ্রোণাচার্য নাকি নিষাদ শিষ্যকে মেনে নিতে পারেননি। নিষাদ হয়ে ক্ষত্রিয়ের মত লক্ষ্যভেদ করা অপরাধ ছিল তখন।


সেই আঙুলই নাকি পোঁতা আছে খন্দসার একলব্য মন্দিরের নীচে। কে জানে কেন তাদের গ্রামের সব ছেলেরাই জন্মায় ডান হাতের বুড়ো আঙুল ছাড়া। নিজের বুড়ো আঙুলহীন ডান হাতের দিকে খানিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় লাখন। কী যে হল এতক্ষণ কে জানে। যাকগে, অনেক কাজ এখন। কত কিছুই তো ঘটে ভগবানের এই আশ্চর্য্য পৃথিবীতে। অত ভাবলে চলে নাকি। গাছতলা ছেড়ে পাশের গ্রামের দিকে পা বাড়ায় লাখন।



35 views0 comments

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page